যাকাত অর্থ পাক হওয়া, বেড়ে, যাওয়া, বিকশিত হওয়া। শরিয়ার পরিভাষায় যাকাত হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদত। প্রত্যেক সাহিবে নিসাব মুসলমান তার মাল থেকে শরিয়তের নির্ধারিত পরিমাণ মাল ঐসব লোকের জন্য বের করে যারা শরিয়ত অনুযায়ী যাকাত নেয়ার হকদার। নামায ও যাকাত প্রকৃতপক্ষে গোটা দ্বীনের প্রতিনিধিত্বকারী দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। দৈহিক ইবাদতে নামায সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর আর্থিক ইবাদতে যাকাত সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে। নামায আল্লাহর হক আদায় করার জন্য বান্দাহকে তৈরি করে এবং যাকাত বান্দাহদের হক আদায় করার গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। যাকাত দিলে ব্যক্তির সম্পদ কমে না বরং বাড়ে। যারা গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নির্দেশ মতো তাঁর পথে ব্যয় করেন, পরম করুণাময় আল্লাহ এর বিনিময়ে কেবল পরকালে নয়; দুনিয়াতেও ব্যাপক বরকত, সচ্ছলতা ও উন্নতি দান করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, মূলত যাকাত দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে। (সূরা রুম : ৩৯)।
এখন প্রশ্ন হলো যাকাত যাকাতদাতার সম্পদকে কিভাবে বৃদ্ধি করে? আল-কুরআনের এই ঘোষণা অনুযায়ী যাকাতদাতার সম্পদ কিভাবে বৃদ্ধি পায় তা যাকাতদাতা ও আমাদের সমাজের কেউই অবগত নন। বিষয়টি যদি সবাই জানতেন তাহলে যাকাতদানে উৎসাহিত হতেন।
যাকাতের মর্যাদা
যাকাত ইসলামের তৃতীয় বৃহৎ রুকন বা স্তম্ভ। দ্বীনের মধ্যে নামাযের পরই যাকাতের স্থান। নামাযের মতই মুসলমানদের নিকট যাকাতের ভূমিকা হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু মুসলিম জনগণের কাছে যাকাতের গুরুত্ব সেরূপ হয়নি। নামায কায়েমের জন্য যত মসজিদ তৈরি হয়েছে যাকাত কায়েমের বা আদায়ের জন্য মুসলিম জাহানে বিশেষ করে বাংলাদেশে ততটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এটাই প্রমাণ করে যে, কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ-এ যাকাতকে নামাযের সমগুরুত্ব দিলেও মুসলিম আলেম-ওলামা ও জনগণ যাকাত কায়েমে সে পরিমাণ শুরুত্ব দেননি। তাই ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাতের সুফল থেকে মুসলিম জনগণ আজ বঞ্চিত, অভাবী ও দারিদ্র্যপীড়িত। এ সুযোগে ক্ষুদ্র ঋণের নামে দারিদ্র্য দূর করার জন্য অনেকেই এগিয়ে আসেন। এতে দারিদ্র্য সাময়িকভাবে কিছুটা দূর হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী রূপ লাভ করে। ক্ষুদ্র ঋণের পেছনে পুঁজিপতিদের অদৃশ্য বেনিফিট দারিদ্র্য দূর না করে ওদের নিজেদেরকেই লালন করে থাকে। যদি সত্যিকার দারিদ্র্যবিমোচন করতে হয় তাহলে সুদমুক্ত যাকাতভিত্তিক ব্যবস্থার অন্যকোনো বিকল্প নেই।
যাকাতের মর্মকথা
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যখন মু’মিন তার প্রিয় এবং পছন্দসই মাল আল্লাহ্র পথে সন্তুষ্টচিত্তে ব্যয় করে তখন সে মু’মিনের দিলে এক নূর এবং উজ্জ্বলতা পয়দা হয়। বস্তুগত আবর্জনা ও দুনিয়ার মহব্বত দূর হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা এ আমলের দ্বারা মু’মিনের দিল থেকে দুনিয়ার সকল প্রকার বস্তুগত মহবত বের করে নিয়ে সেখানে তাঁর আপন মহব্বত বসিয়ে দিতে চান। এ জন্য শরিয়ত যাকাতের একটি আইনগত সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছে যে, এতটুকু খরচ না করলে ঈমানই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে।
যাকাতব্যবস্থার উদ্দেশ্য
যাকাতব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে মু’মিনের দিল থেকে দুনিয়ার মহব্বত ও তার মূল থেকে উৎপন্ন যাবতীয় ঝোপ-ঝাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে আল্লাহ্র মহব্বত পয়দা করতে চায়। এটা তখনই সম্ভব যখন মু’মিন বান্দা শুধু যাকাত দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। বরঞ্চ যাকাতের সেই প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা করে এবং মনে করে আমার কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহ্র। যাকাতের ঐ প্রাণশক্তি ও উদ্দেশ্য আত্মস্থ না করে কেউ আল্লাহর জন্য মহব্বত করতে পারে না। আর যা আল্লাহর হক জেনে নিয়ে তা পূরণ করার জন্য সজাগ ও মুক্ত হস্ত হতে পারে। যাকাতব্যবস্থা আসলে গোটা ইসলামী সমাজে কৃপণতা, সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, মনের কঠিনতা এবং শোষণ করার সূক্ষ¥ প্রবণতা থেকে পাক পবিত্র করে। তার মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, ত্যাগ, দয়া-দাক্ষিণ্য, নিষ্ঠা, শুভাকাক্সক্ষা, সহযোগিতা, সাহচর্য প্রভৃতি উন্নত ও পবিত্র প্রেরণার সঞ্চার করে এবং সেগুলোকে বিকশিত করে।
যাকাতের মহত্ত্ব ও গুরুত্ব
ঈমানের পর প্রথম দাবিই হচ্ছে নামায ও যাকাতের। প্রকৃতপক্ষে এ দু’টি ইবাদত পালন করার অর্থ গোটা দ্বীন পালন করা। যে বান্দাহ মসজিদের মধ্যে আল্লাহর সামনে গভীর আবেগ সহকারে তার দেহ ও মন বিলিয়ে দেয়, সে মসজিদের বাইরে আল্লাহ্র হক কিভাবে অবহেলা করতে পারে? ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি তার প্রিয় ধন-সম্পদ আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহ্র পথে সন্তুষ্টচিত্তে বিলিয়ে দিয়ে মনের গভীর শান্তি অনুভব করে, সে অন্যান্য বান্দাদের হক কিভাবে নষ্ট করতে পারে? আর ইসলাম তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও বান্দার হকেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্য কুরআন নামায এবং যাকাতকে ইসলামের পরিচায়ক এবং ইসলামের গভীর মধ্যে প্রবেশের সাক্ষ্য বলে গণ্য করে।
যাকাতের তাকিদ ও প্রেরণা
যাকাতের অসাধারণ গুরুত্ব ও মহব্বতের কারণে কুরআন পাকের বিরাশি স্থানে এর তাকিদ করা হয়েছে। যেমন- নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও। কুরআন সুস্পষ্ট করে বলে যে, অন্তরকে পাক-পবিত্রকারী, সৎ পথের পথিক হিকমতের গুণে গুণান্বিত, আল্লাহর সন্তুষ্টি, মাগফেরাত ও রহমত লাভকারী আখেরাতের চিরন্তন শান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ঐসব লোক যারা সন্তুষ্টচিত্তে হরহামেশা যাকাত দিয়ে থাকে।
যাকাত কিভাবে দারিদ্রবিমোচন ও সম্পদ বৃদ্ধি করে
আমরা জানি যাকাত গ্রহণে দরিদ্র জনগণ আর্থিকভাবে উপকৃত হন। কিন্তু প্রশ্ন হলো যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ কিভাবে বৃদ্ধি পায়? যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদি উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। যাকাত যত বেশি বণ্টন করা হবে সমাজে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তত বাড়বে। যাকাত প্রদান না করলে দরিদ্র্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। ফলে দরিদ্র মানুষ অধিকতর দারিদ্র্যের দিকে যায় এবং ধনীদের অর্থের গতি স্থির হয়ে যায়।
অন্য দিকে যাকাত প্রদানের ফলে মানুয়ের ক্রয়ক্ষমতা যখন বাড়বে তখন মানুষ নিজের মৌলিক চাহিদা মিটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে ক্রয় করে। ফলে টাকা চক্রাকারে পুনরায় ধনীদের নিকট চলে যায়। এভাবে ক্রয়-বিক্রয় করতে করতে দরিদ্র জনগণ স্বাবলম্বী হন এবং ধনীরা পণ্য বিক্রয় করে লভ্যাংশ দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি করে থাকেন। ধনীরা বা সম্পদের মালিকগণ যদি যাকাত দেওয়া বন্ধ করে দেন তাহলে সমাজে ক্রয়ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসবে। ফলে সম্পদের বৃদ্ধিও কমে যাবে। যাকাত প্রদানের ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা যখন বাড়ে, তখন সাথে সাথে জনগণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সরবরাহও বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ বাড়াতে হলে উৎপাদনও বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর হবে। কৃপণ ও লোভী লোকেরা যাকাত দিতে পারে না। লোভ ও কৃপণতা মানুষের অন্তরাত্মাকে সঙ্কীর্ণ ও সঙ্কুচিত করে দেয়। পক্ষান্তরে যাকাত মানুষের এ সঙ্কীর্ণতাকে ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে তার অন্তরকে করে দেয় মুক্ত মহান। যাকাত ধনীদের পক্ষ থেকে দান বা অনুগ্রহ নয়। বরং যাকাত পরিশোধ করা বিত্তবানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য বা ফরয। “আর তাদের ধন-দৌলতে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের অধিকার বয়েছে।” (সূরা আল-যারিয়াত-১৯)
আল্লাহর সাহায্যকারী প্রকৃত ইসলামী সরকারের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা হচ্ছে সেইসব লোক যাদের আমি রাষ্ট্রক্ষমতা দান করলে তারা-(১) সালাত কায়েম করবে (২) যাকাতব্যবস্থা চালু করবে (৩) সৎ কাজের আদেশ করবে এবং (৪) অন্যায় ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে। (সূরা হজ : ৪১)
মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দান করতে বলা হয়নি। এ ছাড়া আর একটি আয়াতে যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারীদের জন্য যাকাতের অর্থের একাংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম সকলের নিকট থেকে যাকাত আদায় করবে এবং সমষ্টিগতভাবে তা খরচ করবে।
রাসূল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলামী সরকার কর্তৃক যাকাত উসুল করা হতো এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তা বণ্টন করা হতো। প্রশ্ন হতে পারে, বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠিত না থাকা অবস্থায় কিভাবে যাকাত পরিশোধ করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাকারী ইসলামী সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যাকাত আদায় করে কুরআন নির্ধারিত খাতসমূহে তা বণ্টনের ব্যবস্থা করাই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা। ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দানের ক্ষেত্রে অনেক ফেতনা রয়েছে। এতে মনে প্রদর্শনেচ্ছা সৃষ্টি হতে পারে। যাকাত দানকে অনুগ্রহ বা করুণা বিবেচনা করা হতে পারে। ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের যে কর্মসূচি তার মধ্যে যাকাত একটা ভূমিকা পালন করে যেখানে রাষ্ট্র যাকাত আদায় করবে। কী পরিমাণ যাকাত আমাদের দেশে আদায় হতে পারে তার একটা হিসাব ২০০২ সালে করা হয়েছে। আমাদের দেশে এক বছরে প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা যাকাত আদায় হতে পারে। যদি সঠিকভাবে যাকাত আদায় করা হয় তাহলে আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। এটা যদি সিস্টেমেটিক্যালি করা যায় সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে এবং এমন ভাবে দেয়া হবে যে গ্রহীতা ব্যক্তি জীবনের মতো স্বাবলম্বী হয়ে যায়। হযরত ওমর রা.-এর বিখ্যাত বক্তব্য হলো :
তুমি এমনভাবে দাও যাতে সে ধনী হয়ে যায়। অর্থাৎ তাকে যেন আর কোনোদিন যাকাত না নিতে হয়। যাতে তার কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থা হয়ে যায়। একটা (ঝবষভ বসঢ়ষড়ুসবহঃ) হয় এবং পরবর্তীতে সে যেন যাকাতগ্রহীতা না হয়ে যাকাতদাতা হতে পারেন। কাজেই যাকাতের কার্যকারিতা পেতে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সা. যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি চালু করার মাত্র পাঁচ বছর পর হযরত ওমর রা. এর আমলে গরিব লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। তাই জাজিরাতুল আরব হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি। বর্তমানে বিশ্বে তথা বাংলাদেশে যাকাতভিত্তিক অর্থনীতির সুফলকে চিন্তা না করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধাঁচে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য পথ খুঁজছে। বাংলাদেশে আজ পুঁজিবাদী অর্থনীতি অসম বণ্টনের ফলে চরম ধনবৈষম্য সৃষ্টি করে ২৫ শতাংশ লোকের কাছে ৭৫ শতাংশ সম্পদ এবং বা ৭৫ শতাংশ লোকের কাছে মাত্র ২৫ শতাংশ সম্পদ, যা এক করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মৌলবাদী অর্থনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি জাতিকে মুক্তি দিতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতকে যদি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাহলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকার ইসলামী সোনালি যুগের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : কর্মকর্তা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড